এই ব্লগটি সন্ধান করুন

বাকবন্দির জবানবন্দি

রবিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১০

 


সকল গৃহ হারালো যার
তসলিমা নাসরিন


"Freedom is always and exclusively freedom for the one who thinks differently"- Rosa Luxemburg




জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যখন দেখি পিছনের দিনগুলো ধূসর ধূসর, আর সেই ধূসরতার শরীর থেকে হঠাৎ হঠাৎ কোনও ভুলে যাওয়া স্বপ্ন এসে আচমকা সামনে দাঁড়ায় বা কোনও স্মৃতি টুপ করে ঢুকে পড়ে আমার একাকী নির্জন ঘরে, আমাকে কাঁপায়, আমাকে কাঁদায়, আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেইসব দিনগুলোর দিকে- তখন কী জীবনের সেই অলিগলির অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে কিছু শীতার্ত স্মৃতি কুড়িয়ে আনতে আমি না হেঁটে পারি! কী লাভ হেঁটে? কী লাভ স্মৃতি কুড়িয়ে এনে! যা গেছে তা তো গেছেই। যে-স্বপ্নগুলো অনেককাল মৃত, যে-স্বপ্নগুলোকে এখন আর স্বপ্ন বলে চেনা যায় না, মাকড়সার জাল সরিয়ে ধুলোর আস্তর ভেঙে কী লাভ সেগুলোকে আর নরম আঙুলে তুলে এনে! যা গেছে, তা তো গেছেই। জানি সব, তবুও আমার নির্যাতনের নির্বাসনের জীবন আমাকে বারবার পিছনে ফিরিয়েছে, আমি আমার অতীত জুড়ে মোহগ্রস্তের মতো হেঁটেছি। দুঃস্বপ্নের রাতের মতো এক একটি রাত আমাকে ঘোর বিষাদে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তখনই মেয়েটির গল্প বলতে শুরু করেছি আমি।
একটি ভীরু লাজুক মেয়ে, যে-মেয়ে সাত চড়েও রা করেনি, পারিবারিক কড়া শাসন এবং শোষণে ছোট্ট একটি গণ্ডির মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে। যে-মেয়ের সাধ-আহ্লাদ প্রতিদিনই ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে আবর্জনার স্তূপে, যে-মেয়েটির ছোট্ট শরীরের দিকে লোমশ লোমশ লোভী হাত এগিয়ে এসেছে বারবার, আমি সেই মেয়ের গল্প বলেছি। যে-মেয়েটি কিশোর বয়সে ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেছে, যে-মেয়েটি হঠাৎ একদিন প্রেমে পড়েছে, যৌবনের শুরুতে বিয়ের মতো একটি কাণ্ড গোপনে ঘটিয়ে আর দশটি সাধারণ মেয়ের মতো জীবনযাপন করতে চেয়েছে, আমি সেই সাধারণ মেয়েটির গল্প বলেছি। যে-মেয়েটির সঙ্গে প্রতারণা করেছে তার স্বামী- তার সবচেয়ে ভালবাসার মানুষ, যে-মেয়েটির বিশ্বাসের দালানকোঠা ভেঙে পড়েছে খড়ের ঘরের মতো, যে-মেয়েটি শোকে, সন্তাপে, বেদনায়, বিষাদে কুঁকড়ে থেকেছে, চরম লজ্জা আর লাঞ্ছনা যাকে আত্মহত্যা করার মতো একটি ভয়ংকর পথে নিয়ে যেতে চেয়েছে, সেই শোকার্ত মেয়েটির গল্প আমি বলেছি। চুরমার হয়ে ভেঙে পড়া স্বপ্নগুলো জড়ো করে যে মেয়েটি আবার বাঁচতে চেয়েছে, নিষ্ঠুর নির্দয় সমাজে নিজের জন্য সামান্য একটু জায়গা চেয়েছে, যে-মেয়েটি বাধ্য হয়েছে সমাজে রীতিনীতি মেনে পুরুষ নামক অভিভাবকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে। আর তার পরও যে মেয়েটির ওপর আবার নেমে এসেছে একের পর এক আঘাত, যে-আঘাত গর্ভের ভ্রুণটিকে নষ্ট করে দেয়, যে-আঘাত প্রতি রাতে তাকে রক্তাক্ত করে, যে-আঘাত ক্রুরতার, কুটিলতার, অবিশ্বাসের আর অসহ্য অপমানের- আমি সেই দলিত দংশিত দুঃখিতার গল্প বলেছি মাত্র। দুঃখিতাটি তার শরীরে আর মনে যেটুকু জোর ছিল অবশিষ্ট, সেটুকু নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়াবার জন্য সামান্য জায়গা পেতে কারও দ্বারস্থ হয়নি এবার, একাই লড়েছে সে, একাই বেঁচেছে, নিজেই নিজের আশ্রয় হয়েছে, এবার আর কারও কাছে নিজেকে সমর্পণ করেনি, বঞ্চিত হয়েছে বলে যোগিনী সাজেনি, কারও ছিঃ ছিঃ-র দিকে তাকায়নি, কারও ধিক্কারের দিকে ফিরে তাকায়নি - এই ফিরে না তাকানোর গল্প আমি বলেছি। সমাজের সাত রকম সংস্কারের ধার ধারেনি মেয়ে, বারবার তার পতনই তাকে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, বারবার তার পথ হারানোই তাকে খুঁজে দিয়েছে পথ। ধীরে ধীরে নিজের ভেতর যে-নতুন একটি বোধ আর বিশ্বাসকে সে জন্ম নিতে দেখেছে, তা হল, তার নিজের জীবনটি কেবল তারই, অন্য কারও নয়। এই জীবনটির কর্তৃত্ব করার অধিকার কেবল তারই। আমি মেয়েটির সেই গড়ে ওঠার গল্প বলেছি - যে-পরিবেশ প্রতিবেশ তাকে বিবর্তিত করেছে, তাকে নির্মাণ করেছে, পিতৃতন্ত্রের আগুনে পুড়ে পুড়ে শেষ পর্যন্ত যে-মেয়ে দগ্ধ হল না, পরিণত হল ইস্পাতে, সেই গল্প।
আমি কি অন্যায় কিছু করেছি? আমার কাছে অন্যায় বলে মনে না হলেও আজ অনেকের কাছে এটি ঘোরতর অন্যায়। আমি ভয়াবহ অপরাধ করেছি গল্পটি বলে। অপরাধ করেছি বলে জনতার আদালতের কাঠগড়ায় আজ আমাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। অপরাধ হয়তো হত না যদি না আমি প্রকাশ করতাম যে, যে-মেয়েটির গল্প আমি বলেছি সে মেয়েটি আমি, আমি তসলিমা। কল্পনায় আমি যথেচ্ছাচার করতে পারি, মিথ্যে মিথ্যে আমি লিখতে পারি কোনও সাধারণ মেয়ের আর দশটি মেয়ে থেকে ভিন্ন হওয়ার গল্প, ও না হয় ক্ষমা করে দেওয়া যায়। কিন্তু এই বাস্তব জগৎটিতে দাঁড়িয়ে রক্তমাংসের মেয়ে হয়ে কোন স্পর্ধায় আমি ঘোষণা করছি যে, ওই মেয়েটি আমি, আমি দুঃখ ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, আমার যেমন ইচ্ছে তেমন করে নিজের জীবনটি যাপন করব বলে পণ করেছি, আমার এই দূর্বিনীত আচরণ লোকে মানবে কেন! এরকম স্পর্ধা কোনও মেয়েদেরই মানায় না। বড় বেমানান আমি পুরো পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে।
আমার প্রিয় দেশটিতে, প্রিয় পশ্চিমবঙ্গে আজ আমি একটি নিষিদ্ধ নাম, একটি নিষিদ্ধ মানুষ, একটি নিষিদ্ধ বই। আমাকে উচ্চারণ করা যাবে না, আমাকে ছোঁয়া যাবে না, আমাকে পড়া যাবে না। উচ্চারণ করলে জিভ নষ্ট হবে, ছুঁলে হাত নোংরা হবে, পড়লে গা রি রি করবে।
এরকমই তো আমি। সে কি আজ থেকে!
"দ্বিখন্ডিত" লেখার কারণে যদি সহস্র খন্ড হতে হয় আমাকে, তবু আমি স্বীকার করতে চাই না যে আমি কোনও অপরাধ করেছি। আত্মজীবনী লেখা কী অপরাধ? জীবনের গভীর গোপন সত্যগুলো প্রকাশ করা কি অপরাধ? আত্মজীবনীর প্রধান শর্ত তো এ-ই যে, জীবনের সব কিছু খুলে মেলে ধরব, কোনও গোপন কথা কোনও কিছুর তলায় লুকিয়ে রাখব না। যা-কিছু গোপন, যা-কিছু অজানা, তা বলার জন্যই তো আত্মজীবনী। এই শর্তটাই সততার সঙ্গে পালন করতে চেষ্টা করছি। আত্মজীবনীর প্রথম দুই খণ্ড 'আমার মেয়েবেলা' আর 'উতল হাওয়া' নিয়ে কোনওরকম বিতর্ক না হলেও তৃতীয় খণ্ডটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্ক কিন্তু আমি প্রথম সৃষ্টি করিনি, করেছে অন্যরা। বিতর্ক হওয়ার মতো উত্তেজক বিষয়, অনেকেই বলেছেন, আমি বেছে নিয়েছি। এই প্রশ্ন আর যখনই উঠুক, আত্মজীবনীর ক্ষেত্রে ওঠা উচিত নয়। কারণ সব রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমার বড় হওয়া বা বেড়ে ওঠার ঘটনাগুলোই আমি বর্ণনা করেছি। আমার দর্শন-অদর্শন, আমার হতাশা-আশা, আমার সুন্দর, আমার কুৎসিত, আমার শোক সুখ, আমার ক্রোধ আর কান্নাগুলোর কথাই বলেছি। কোন স্পর্শকাতর বা উত্তেজক বিষয় শখ করে বেছে নিইনি, আমার জীবনটিই আমি বেছে নিয়েছি জীবনী লেখার জন্য। এই জীবনটা যদি স্পর্শকাতর আর উত্তেজক হয়, তবে এই জীবনের কথা লিখতে গিয়ে আমি অস্পর্শকাতর আর অনুত্তেজক বিষয় কোত্থেকে পাব? বিতর্ক তৈরী করার জন্য বা চমক সৃষ্টি করার জন্য আমি নাকি বইটি লিখেছি। যেন বদ একটি কারণ থাকতেই হবে বই লেখার পিছনে। যেন সততা আর সরলতা কোনও কারণ হতে পারে না। যেন সাহসের, যে-সাহসের প্রশংসা করা হত যে, আমি সাহস করে নাকি অনেক কিছুই বলি বা করি, সেই সাহসটিও এখন আর কোনও কারণ হতে পারে না। আমার লেখা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। লেখালেখির শুরু থেকেই তা হচ্ছে। এটাই কি মোদ্দা কথা নয় যে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের সঙ্গে আপোস না করলেই বিতর্ক হয়!
আত্মজীবনীর সংজ্ঞা অনেকের কাছে অনেক রকম। বেশির ভাগ মানুষই সেই আত্মজীবনীকে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত, যে-জীবনীটি ভুরি ভুরি ভাল কথা আর চমৎকার সব আদর্শ উপস্থাপন করে। সাধারণত মনীষীরাই আত্মজীবনী লিখে যান অন্যকে নিজের জীবনাদর্শে আলোকিত করতে, সত্যের সন্ধান দিতে, পথ দেখাতে। আমি কোনও জ্ঞানীগুণী মানুষ নই, মনীষী নই, মহামানব নই, কিছু নই, অন্ধজনে আলো দেওয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আমি জীবনী লিখছি না। আমি কেবল ক্ষুদ্র একটি মানুষের ক্ষতগুলো ক্ষোভগুলো খুলে দেখাচ্ছি।
কোনও বড় সাহিত্যিক বা বড় কোনও ব্যক্তিত্ত্ব না হলেও এ কথা তো অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, খুব বড় বড় ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনটিতে। আমার বিশ্বাস এবং আদর্শের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি পথে নামে আমার ফাঁসির দাবি নিয়ে, যদি ভিন্ন মতের কারণে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করা হয়, যদি সত্য কথা বলার অপরাধে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র আমার নিজের দেশে বাস করার অধিকার হরণ করে নেয়, তবে নিশ্চয়ই জীবনটি একটি সাদামাটা জীবন নয়! এই জীবনের কাহিনী অন্যের মুখে নানা ঢঙে নানা রঙে প্রচারিত যখন হচ্ছেই, তখন আমি কেন দায়িত্ব নেব না জীবনটির আদ্যোপান্ত বর্ণনা করতে! আমার এই জীবনটিকে আমি যত বেশি জানি, তত তো আর কেউ জানে না।
নিজেকে যদি উন্মুক্ত না করি, নিজের সবটুকু যদি প্রকাশ না করি, বিশেষ করে জীবনের সেইসব কথা বা ঘটনা, যা আমাকে আলোড়িত করেছে, যদি প্রকাশ না করি নিজের ভাল মন্দ, দোষ গুণ, শুভ অশুভ, আনন্দ বেদনা, উদারতা ক্রুরতা, তবে আর যাই হোক সেটি আত্মজীবনী নয়, অন্ততঃ আমার কাছে নয়। কেবল সাহিত্যের জন্য সাহিত্যই আমার কাছে শেষ কথা নয়, সততা বলে একটি জিনিস আছে, সেটিকে আমি খুব মূল্য দিই।
যে-রকমই জীবন হোক আমার, যে-রকমই নিকৃষ্ট, যে-রকমই নিন্দার্হ, নিজের জীবনকাহিনী লিখতে বসে আমি কিন্তু প্রতারণা করছি না নিজের সঙ্গে। পাঠক আমার গল্প শুনে আমাকে ঘৃণা করুক কি ছুঁড়ে ফেলুক, এটুকুই আমার সন্তুষ্টি যে, আমার পাঠকের সঙ্গে আমি প্রতারণা করছি না। আত্মজীবনী নাম দিয়ে পাঠককে কোনও বানানো গল্প উপহার দিচ্ছি না। জীবনের সব সত্য, সত্য সবসময় শোভন বা সুন্দর না হলেও, সঙ্কোচহীন বলে যাচ্ছি। জীবনে যা-কিছু ঘটে গেছে, তা তো ঘটেই গেছে, তা তো আমি বদলে দিতে পারব না, আর অস্বীকারও করতে পারব না এই বলে যে, যা ঘটেছে তা আসলে ঘটেনি, সুন্দরকে যেমন পারি, অসুন্দরকেও তেমন আমি স্বীকার করতে পারি।
চারদিক থেকে এখন বিদ্রুপের তির ছোঁড়া হচ্ছে আমাকে লক্ষ্য করে, অপমান আর অপবাদের কাদায় আমাকে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে- এর কারণ, একটিই, আমি সত্য কথা বলেছি। সত্য সবসময় সবার সয় না। 'আমার মেয়েবেলা" আর 'উতল হাওয়া'র সত্য সইলেও 'দ্বিখন্ডিত'র সত্য সবার সইছে না। 'আমার মেয়েবেলা'য় আমাকে অপদস্থ করার কাহিনী যখন বর্ণনা করেছি, সেটি শুনে লোকে চুক চুক করে দুঃখ করেছে আমার জন্য, 'উতল হাওয়া'য় যখন স্বামী দ্বারা প্রতারিত হয়েছি, তখনও আহা আহা করেছে আমার জন্য, আর 'দ্বিখণ্ডিত'য় বর্ণনা করেছি একাধিক পুরুষের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা, তখন ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করেছে। এর অর্থ তো একটিই যে, যতক্ষণ একটি মেয়ে অত্যাচারিত এবং অসহায়, যখনই সে দূর্বল এবং যখন তার দুঃসময়, ততক্ষণই তার জন্য মায়া জাগে, ততক্ষণই তাকে ভাল লাগে। আর যখনই মেয়েটি আর অসহায় নয়, অত্যাচারিত নয়, যখনই সে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ায়, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, নিজের শরীরের এবং মনের স্বাধীনতার জন্য সমাজের নষ্ট নিয়মগুলো ভাঙে, তখন তাকে আর ভাল লাগে না, বরং তার প্রতি ঘৃণা জন্মে। আমাদের সমাজের এই চরিত্র আমি জানি,জেনেও আমি দ্বিধা করিনি নিজেকে জানাতে।
'দ্বিখণ্ডিত' বইটি নিয়ে বিতর্কের একটি বড় কারণ, যৌন স্বাধীনতা। আমাদের এই সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তাই একজন নারীর যৌন স্বাধীনতার অকপট ঘোষণায় বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। যে-যৌন স্বাধীনতার কথা আমি বলি, তা কেবল আমার বিশ্বাসের কথাই নয়, নিজের জীবন দিয়ে সেই স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছি, অথচ যে-কোনও পুরুষ আমাকে কামনা করলেই পাবে না। এই সমাজ এখনও কোনও নারীর এমন স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত নয়। প্রস্তুত নয় এটা শিরোধার্য করতে যে, কোনও নারী তার ইচ্ছেমতো পুরুষকে সম্ভোগ করতে পারে এবং তা করেও কঠোরভাবে যৌন-সতীত্ব বজায় রাখতে পারে।
আমাদের নামি-দামি পুরুষ-লেখকরা আমাকে মহানন্দে পতিতা বলে গাল দিচ্ছেন। গাল দিয়ে নিজেরাই প্রমাণ করছেন কী ভীষণ নোংরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সুবিধাভোগী পুরুষ-কর্তা তাঁরা! পতিতাকে তাঁরা ভোগের জন্য ব্যবহার করেন, আবার পতিতা শব্দটিকে তাঁরা সময় সুযোগমতো গাল হিসেবেও ব্যবহার করেন। নারীকে যৌন-দাসী হিসেবে ব্যবহার করার নিয়ম আজকের নয়। যদিও 'দ্বিখণ্ডিত' বইটিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে আমার লড়াইয়ের কথা বলেছি, বলেছি নারী আর ধর্মীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে আমার লড়াইয়ের কথা বলেছি, বলেছি নারী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সমাজের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা, কেউ কিন্তু সে নিয়ে একটা কথাও বলছেন না, যাঁরাই বলছেন, বলছেন যৌনতার কথা। আমার কোনও কষ্টের দিকে কান্নার দিকে কারও চোখ গেল না, চোখ গেল শুধু যৌনতার দিকে। চোখ গেল আমার সঙ্গে পুরুষের সম্পর্কগুলোর দিকে। যৌনতার মতো গভীর গোপন কুৎসিত আর কদর্য বিষয় নিয়ে আমার মুখ খোলার স্পর্ধার দিকে চোখ।
পৃথিবীর ইতিহাসে, কোনও অন্ধকার সমাজে যখনই কোনও নারী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে, নিজের স্বাধীনতার কথা বলেছে, ভাঙতে চেয়েছে পরাধীনতার শেকল, তাকেই গাল দেওয়া হয়েছে পতিতা বলে। অনেক আগে 'নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য' বইটির ভূমিকায় আমি লিখেওছিলাম, 'নিজেকে এই সমাজের চোখে নষ্ট বলতে আমি ভালোবাসি। কারণ এ কথা সত্য যে, যদি কোনও নারী নিজের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করতে চায়, যদি কোনও নারী কোনও ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের নোংরা নিয়মের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়, তাকে অবদমনের সকল পদ্ধতির প্রতিবাদ করে, যদি কোনও নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়, তবে তাকে নষ্ট বলে সমাজের ভদ্রলোকেরা। নারীর শুদ্ধ হবার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া। নষ্ট না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই। সেই নারী সত্যিকার সুস্থ ও শুদ্ধ মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে।' আজও এ কথা আমি বিশ্বাস করি যে, কোনও নারী যদি তার স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়, যদি সত্যিকার মানুষ হতে চায়, তবে এই সমাজের চোখে তাকে নষ্ট হতে হয়। এই নষ্ট সমাজ থেকে নষ্ট বা পতিতা আখ্যা উপহার পাওয়া একজন নারীর জন্য কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়। এ যাবৎ যত পুরষ্কার আমি পেয়েছি, পতিতা উপাধির পুরষ্কারটিকেই আমি সর্বোত্তম বলে বিচার করি। এ আমার লেখকজীবনের, আমার নারীজীবনের, আমার দীর্ঘকালের সংগ্রামের স্বার্থকতা।
বইটি লিখেছি বলে বাংলাদেশের একজন লেখক আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন, কলকাতাতেও একজন বাংলাদেশী লেখকটির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। কেবল মানহানির মামলা করেই ক্ষান্ত হননি, দু'জনই আমার বইটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। আমি ঠিক বুঝি না, কী করে একজন লেখক আর একজন লেখকের বই নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন! কী করে সমাজের সেই শ্রেণীর মানুষ, যাঁদের দায়িত্ব মুক্ত চিন্তা আর বাক স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করা, মৌলবাদীদের মতো আচরণ করেন! আমাকে নিয়ে এ যাবৎ অনেক মিথ্যে, অনেক কল্পকাহিনী লেখা হয়েছে, আমি তো তাঁদের কোনও লেখাই নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে আদালতে দৌড়োইনি! আমি বিশ্বাস করি, ভলতেয়ার যা বলেছিলেন, je ne suis absolument pas d'accord aves vos ideas, mais je ma battarais pour que vous puissiez les exprimer- আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু আমি আমৃত্যু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য লড়ে যাব। কেন আমাদের বিদগ্ধ লেখকগণ বাক-স্বাধীনতার পক্ষে এই চরম সত্যটির অস্বীকার করতে চান!
পৃথিবীর কত লেখকই তো লিখে গেছেন নিজেদের জীবনের কথা। জীবন থেকে কেবল পরিশুদ্ধ জিনিস ছেঁকে নিয়ে তাঁরা পরিবেশন করেননি। জীবনে ভ্রান্তি থাকে, ভুল থাকে, জীবনে কালি থাকে, কাঁটা থাকে, কিছু না কিছু থাকেই, সে যদি মানুষের জীবন হয়। যাঁদের মহামানব বলে শ্রদ্ধা করা হয়, তাঁদেরও থাকে। ক্রিশ্চান ধর্মগুরু অগুস্তঁ (৩৩৫-৪৩০ খ্রি.) নিজেই লিখে গেছেন তাঁর জীবনকাহিনী, আলজেরিয়ায় তিনি যেভাবে জীবন কাটাতেন, যে রকম অসামাজিক অনৈতিক বাঁধনহীন জীবন- কিছুই প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তাঁর যৌন স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, জারজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার কোনও কাহিনীই গোপন করেননি। মহাত্মা গাঁধীও তো স্বীকার করে গেছেন কী করে তিনি তাঁর বিছানায় মেয়েদের শুইয়ে নিজের ব্রহ্মচারিতার পরীক্ষা করতেন। ফরাসি লেখক জ্যঁ জ্যাক রুশোর (১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.) কথাই ধরি, তাঁর স্বীকারোক্তি গ্রন্থটিতে স্বীকার করে গেছেন জীবনে কী কী করেছেন তিনি। কোনও গোপন কৌটোয় কোনও মন্দ কথা নিজের জন্য তুলে রাখেননি। সেই আমলে রুশোর আদর্শ মেনে নেওয়ার মানসিকতা খুব কম মানুষেরই ছিল। তাতে কি? তিনি তার পরোয়া না করে অকাতরে বর্ণনা করেছেন নিজের কুকীর্তির কাহিনী। মাদমাজোল গঁতো তো আছেই, এমনকী মাদাম দ্য ওয়ারেন, যাঁকে মা বলে ডাকতেন, তাঁকে দেখেও, বলেছেন যে, তাঁর যৌনাকাঙ্খা জাগত। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৯-১৭৯০ খ্রি.) তাঁর আত্মকথায় যৌবনের উতল উন্মাতাল সময়গুলোর বর্ণনা করেছেন, জারজ পুত্র উইলিয়ামকে নিজের সংসারে তুলে এনেছিলেন, তাও বলেছেন। ব্রার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর জীবনীগ্রন্থে লিখে গেছেন বিভিন্ন রমণীর সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্কের কথা। টি এস এলিয়টের স্ত্রী ভিভিয়ানের সঙ্গে, লেডি অটোলিন মোমেলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা কে না জানে। লিও তলস্তয় লিখেছেন চোদ্দো বছর বয়সেই তাঁর গণিকাগমনের কাহিনী, সমাজের নিচুতলার মেয়ে, এমনকী পরস্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর যৌন সম্পর্ক, এমনকী তাঁর যৌনরোগে ভোগার কথাও গোপন করেননি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন তাঁরা, সমাজ যা মেনে নিতে পারে না, এমন তথ্য পাঠককে শোনাতে গেলেন। শোনানোর নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। নিজেদের আসল পরিচয়টি তাঁরা লুকোতে চাননি অথবা এই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই শুনিয়েছেন। এতে কি তাঁদের জাত গিয়েছে নাকি তাঁদের মন্দ বলে কেউ? কেউই তাঁদের মন্দ বলে না, যে অবস্থানে ছিলেন তাঁরা সে অবস্থানে তো আছেনই, বরং সত্য প্রকাশ করে নিজেদের আরও মহিমান্বিত করেছেন। পশ্চিমি দেশগুলোয় নারী পুরুষ সম্পর্কটি বহুকাল হল আর আড়াল করার ব্যাপার নয়। হালের ফরাসি মেয়ে ক্যাথারিন মিলে তাঁর নিজের কথাই লিখেছেন La vie sexualle de Catherine M বইটিতে। পুরো বই জুড়ে আছে ষাটের দশকে অবাধ যৌনতার যুগে তাঁর বহু পুরুষ-ভোগের রোমাঞ্চকর কাহিনী। পুরো বই জুড়ে মৈথুনের নিঁখুত বর্ণনা। এতে কী হয়েছে? বইটিকে কি সাহিত্যের বইয়ের তাকে রাখা হয়নি? হয়েছে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজও Vivir para contarla বইটিতে পরনারীদের সঙ্গে তাঁর লীলাখেলার কিছুই বলতে বাদ রাখেননি। মার্কেজকে কি কেউ মন্দ বলবে তাঁর জীবনটির জন্য, নাকি কেউ আদালতে যাবে বইটি নিষিদ্ধ করতে?
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বিখ্যাত মানুষদের জীবনী প্রকাশ হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে যেসব জীবনী লিখছেন জীবনীকাররা। খুঁড়ে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে সব গোপন খবর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপন কথাটিও তো রইছে না গোপনে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কথা বলেও তিনি কেন নিজের বালিকা কন্যাটির বিয়ের আয়োজন করেছিলেন, সেই কারণটি আজ মানুষ জানছে। প্রশ্ন হল, এইসব তথ্য কী আদৌ পাঠকের জানা প্রয়োজন? কে কবে কোথায় কী করেছিলেন, কী বলেছিলেন, জীবনাচরণ ঠিক কেমন ছিল কার, তা জানা যদি নিতান্তই অবান্তর হত, তবে তা নিয়ে গবেষণা হয় কেন? জীবনীকার গবেষকরা যেসব মানুষ সম্পর্কে অজানা তথ্য জানাচ্ছেন, সেসব তথ্যের আলোয় শুধু মানুষটি নন, তাঁর সৃষ্টিরও নতুন করে বিচার ও বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে।
বাঙালি পুরুষ লেখকদের অনেকেই গোপনে গোপনে বহু নারীর সঙ্গে শরীরী প্রেমের খেলা খেলতে কুণ্ঠিত নন, নিজেদের জীবনকাহিনীতে সেসব ঘটনা আলগোছে বাদ দিয়ে গেলেও উপন্যাসের চরিত্রদের দিয়ে সেসব ঘটাতে মোটেও সংকোচ বোধ করেন না। কেউ কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। প্রশ্ন ওঠে, কোনও মেয়ে যদি যৌনতা নিয়ে কথা বলে। সে গল্প উপন্যাসে হোক, সে আত্মজীবনীতে হোক। যৌনতা তো পুরুষের 'বাপের সম্পত্তি'। আমার তো পুরুষ-লেখকদের মতো লিখলে চলবে না। আমার তো রয়ে-সয়ে লিখতে হবে! রেখে-ঢেকে লিখতে হবে। কারণ আমি তো নারী। নারীর শরীর, তার নিতম্ব, স্তন, ঊরু, যোনি এসব নিয়ে খেলা বা লেখার অধিকার তো কেবল পুরুষেরই আছে। নারীর থাকবে কেন? এই অধিকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাকে দেয়নি, দেয়নি বলে তোয়াক্কা না করে আমি যে লিখে ফেলেছি, যত করুণ হোক, যত মর্মান্তিক হোক আমার সে কাহিনী, আমি যে অনধিকার চর্চা করেছি, তাতেই আপত্তি।
পুরুষের জন্য একাধিক প্রেম বা একাধিক নারীসম্ভোগ চিরকালই গৌরবের ব্যাপার। আর একটি মেয়ে সততার সঙ্গে কাগজেকলমে নিজের প্রেম বা যৌনতা নিয়ে যেই না লিখেছে, অমনি সেই মেয়ে বিশ্বাসঘাতিনী, সেই মেয়ে অসতী, সেই মেয়ে দুশ্চরিত্র। আমার আত্মজীবনীতে আমি এমন কথা বলেছি, যা বলতে নেই। আমি সীমা লঙ্ঘন করেছি, আমি বাড়াবাড়ি করেছি, আমি অশ্লীলতা করেছি, নোংরা কুৎসিত ব্যাপার ঘেঁটেছি। দরজা বন্ধ করে যে ঘটনাগুলো ঘটানো হয়, পারস্পারিক বোঝাপড়ায় যে সম্পর্কগুলো হয়, সেসব নাকি বলা অনুচিত। সেসব নাকি বলা জরুরি নয়। কিন্তু আমি তো মনে করি উচিত, আমি তো মনে করি জরুরি। কারণ আমার সংস্কার সংস্কৃতি, ধ্যান, ধারণা, বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে আজ এই যে আমি, এই তসলিমার নির্মাণ কাজে জীবনের সেইসব ঘটনা বা দূর্ঘটনাই অন্যতম মৌলিক উপাদান। আমি যে ভুঁইফোঁড় নই, তিল তিল করে চারপাশের সমাজ নির্মাণ অরেছে তিলোত্তমার বিপরীত এই অবাধ্য কন্যার। নিজেকে বোঝার জন্য, আমি মনে করি, জরুরি এই আত্মবিশ্লেষণ।
নিজের সম্মান না হয় নষ্ট করেছি, অন্যের সম্মান কেন নষ্ট করতে গেলাম! যদিও অন্যের জীবনী আমি লিখছি না, লিখছি নিজের জীবনী, কিন্তু অন্যের পারিবারিক সামাজিক ইত্যাদি সম্মানহানির বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি ঠিক বুঝি না, নিজের মানসম্মানের ব্যাপারে যাঁরা এত সচেতন তাঁরা এমন কাণ্ড জীবনে ঘটান কেন, যে কাণ্ডে তাঁরা ভাল করে জানেন যে তাঁদের মানের হানি হবে! আমি বিশ্বাসভঙ্গ করেছি! কিন্তু, আমি তো কাউকে প্রতিশ্রুতি দিইনি যে এসব কথা কোনওদিন প্রকাশ করব না! অলিখিত চুক্তি নাকি থাকে। আসলে এই চুক্তিটির অজুহাত তাঁরাই তুলছেন, গোপন কথা ফাঁস হয়ে গেলে নিজেদের দেবতা চরিত্রটিতে দাগ পড়বে বলে যাঁরা আশঙ্কা করছেন। আর তাই চোখরাঙিয়ে শাসিয়ে দিতে চান যে সীমানা লঙ্ঘন করলে চুক্তিভঙ্গের অপরাধে আমার শাস্তি হবে।
আমি যা প্রকাশ করতে চাই তা যদি আমার কাছে উচিত মনে হয়- তবে? উচিত অনুচিতের সংজ্ঞা কে কাকে শেখাবে? আমার কাছে যদি অশ্লীল মনে না হয় সে কথাটি, যে কথাটি আমি উচ্চারণ করছি - তবে? শ্লীল অশ্লীল হিসেব করার মাতব্বরটি কে? সীমা মেপে দেবার দায়িত্বটি কার? আত্মজীবনীতে আমি কী লিখব না লিখব, কতটুকু লিখব, বা লিখব না, তার সিদ্ধান্ত আমিই নেব! নাকি অন্য কেউ, কোনও মকসুদ আলী, কোনও কেরামত মিয়া বা পরিতোষ বা হরিদাস পাল বলে দেবে কী লিখব, কতটুকু লিখব!
সমালোচকরা আমার স্বাধীনতাকে চিহ্নিত করতে চাইছেন স্বেচ্ছাচারিতা বলে। আসলে আমাদের সুরুচি কুরুচি বোধ, পাপ পুণ্য বোধ, সুন্দর অসুন্দর বোধ, সবই যুগ-যুগান্ত ধরে পিতৃতন্ত্রের শিক্ষার পরিণাম। নারীর নম্রতা, নতমস্তকতা, সতীত্ব, সৌন্দর্য, সহিষ্ণুতা সেই শিক্ষার ফলেই নারীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত চেতনা কোনও রুঢ় সত্যের মুখোমুখি হতে তাই আতঙ্ক বোধ করে। কোনও নিষ্ঠুর বাক্য শুনলে কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করে, ঘৃণায় ঘিনঘিন করে গা, অনেক সমালোচকেরও বাস্তবে তাই হচ্ছে। আমি লেখক কি না, আমার আত্মজীবনী তাও আবার ধারাবাহিকভাবে লেখার অধিকার আছে কি না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন। বস্তুত সবার, যে কোনও মানুষেরই লেখার অধিকার আছে। এমনকী আত্মম্ভর সেই সাংবাদিকেরও সেই অধিকার আছে যিনি মনে করেন আমার হাতে কলম থাকাই একটি ঘোর অলুক্ষুণে ব্যাপার। আমাকে দোষ দেওয়া হচ্ছে এই বলে যে, আমি চরম দায়িত্বহীনতার কাজ করেছি। আমি দায়িত্বহীন হতে পারি, যুক্তিহীন হতে পারি, তবু কিন্তু আমার অধিকারটি ত্যাগ করতে আমি রাজি নই। জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, A reasonable man adopts himself to the world. An unreasonable man persists in trying to adopt the world to himself. Therefore, all progress depends upon the unreasonable man. বুদ্ধিমান বা যুক্তিশীল লোকেরা পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে চলে। নির্বোধ বা যুক্তিহীনরা চেষ্টা করে পৃথিবীকে তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে। অতএব সব প্রগতি নির্ভর করে এই যুক্তিহীনদের ওপর। আমি তসলিমা সেই যুক্তিহীনদেরই একজন। আমি তুচ্ছ একজন লেখক, এত বড় দাবি আমি করছি না যে পৃথিবীর প্রগতি আমার ওপর সামান্যতম নির্ভর করে আছে। তবে বিজ্ঞদের বিচারে আমি নির্বোধ বা যুক্তিহীন হতে সানন্দে রাজি। নির্বোধ বলেই তো মুখে কুলুপ আঁটিনি, যে কথা বলতে মানা সে কথা বলেছি, পুরো একটি সমাজ আমাকে থুথু দিচ্ছে দেখেও তো সরে দাঁড়াইনি, নির্বোধ বলেই পিতৃতন্ত্রের রাঘব বোয়ালরা আমাকে পিষে মারতে আসছে দেখেও দৃঢ় দাঁড়িয়ে থেকেছি। আমার মূর্খতাই, আমার নির্বুদ্ধিতাই, আমার যুক্তিহীনতাই সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
ধর্মের কথাও উঠেছে। আমি, যাঁরা আমাকে জানেন, জানেন যে, সব ধরনের ধর্মীয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলি। ধর্ম তো আগাগোড়াই পুরুষতান্ত্রিক। ধর্মীয় পুরুষ ও পুঁথির অবমাননা করলে সইবে কেন পুরুষতান্ত্রিক ধারক এবং বাহকগণ! ওই মহাপুরুষেরাই তো আমাকে দেশছাড়া করেছেন। সত্যের মূল্য আমি আমার জীবন দিয়ে দিয়েছি। আর কত মূল্য আমাকে দিতে হবে!
দাঙ্গার অজুহাত দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নয়, এর আগেও বাংলাদেশে আমার বই নিষিদ্ধ হয়েছে। এই যে নিরন্তর দাঙ্গা হচ্ছে উপমহাদেশে, আমার বই বা বক্তব্য কিন্তু দাঙ্গার কোনও কারণ নয়। কারণ অন্য। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারে, গুজরাতের মুসলমান নিধনে, অসমে বিহারি নিগ্রহে, খ্রিস্টানদের ওপর হামলায়, পাকিস্তানে সিয়া সুন্নি হানাহানিতে আদৌ আমি কোনও ঘটনা নই। অকিঞ্চিৎকর লেখক হলেও আমি মানবতার জন্যই লিখি, ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষই যে সমান, সকলেরই যে সমান অধিকার মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার, সে কথাটিই হৃদয় দিয়ে লিখি। না, আমার লেখার কারণে দাঙ্গার মতো ভয়াবহ কোনও দূর্ঘটনা ঘটে না। যদি কিছু ঘটে, সে আমার জীবনেই ঘটে। আমার লেখার কারণে শাস্তি এক আমাকেই পেতে হয়, অন্য কাউকে নয়। আগুণ আমার ঘরেই লাগে। সকল গৃহ হারাতে হয় এই আমাকেই।

দেশ

১৭।১২।০৩

Kya Sharam ki Bat by tamosodeep

(তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে গানটা গেয়েছেন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়,লিখেছেনও তিনি নিজেই )